প্রত্যয় ডেস্ক, গাজী মো. তাহেরুল আলম, ভোলা৷ বিশেষ প্রতিনিধিঃ জীবনের গতি যেনো থামছে না তাঁর। রাজশাহীর আঁকাবাঁকা পথে বিরামহীন ছুটে চলা। নেই এতোটুকু ক্লান্তি। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও কাজ করছেন তিনি।
পরিবারের ইচ্ছায় কৈশোর না পেরুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় রাজশাহীর দিল আফরোজ খুকিকে। কিন্তু অকালেই বিধবা হন। আশ্রয় নেন রাজশাহী নগরীর শিরোইলের বাবার বাড়ি। কিন্তু তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় পরিবার।
বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও প্রায় ৩০ বছর ধরে পেপার বিক্রি করে জীবন চলছে তার। পেপার বিক্রির আয় থেকে অসহায়-দরিদ্রদের সেবাও করছেন নীরবে।
পরিবারের সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, তার বাবা ছিলেন রাজশাহী জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট এবং মা সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষিকা। সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে খুকি দশম। টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বিয়ের পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অকালে স্বামীর মৃত্যু তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফলে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হয়ে যান।
বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে দ্বিতীয় বিয়ে না করে স্বাবলম্বী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খুকি। তার এ জীবনযুদ্ধে কাউকে সঙ্গে পাননি। ফলে পেপার বিক্রি শুরু করেন। পেপার বিক্রি করায় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিবার ও স্বজন। কিন্তু তাতেও দমেননি খুকি। ৩০ বছর ধরে পেপার হাতে রয়েছেন রাস্তায়। খুকি এখন বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। তাতেও যেন বিরাম নেই।
তিনি বলেন, ‘আমি খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজের জীবন চালাচ্ছি, এটা কি অসম্মানের? এটা কীভাবে অন্যের সম্মানহানি করে? কোনো কাজই ছোট নয়। অন্যের ওপর নির্ভরশীল জীবন কষ্টের। নিজেকে সবসময় জ্বলন্ত মোমবাতি মনে করেন খুকি। বলেন, কখন যে নিভে যাব জানি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্বলবো।’
কারা তার সেবা নিয়েছেন জানতে চাইলে খুকি জানান, অসহায় অনেক নারীকে সেলাই মেশিন এবং তাদের স্বামীদের সাইকেল কিনে দিয়েছি। এখনো নিয়মিত এতিমখানা, মসজিদ এবং মন্দিরে দান করি। বেশ কয়েকটি পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে গবাদিপশু কিনে দিয়েছি। এর সবই করেছি সংবাদপত্র বিক্রির আয় আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাড়া জাগানো সাপ্তাহিক ‘দুনিয়া’ হাতে নিয়ে পথে নামেন খুকি। এখন সাপ্তাহিক দুনিয়া বন্ধ। কিন্তু থামেনি তার পথচলা। নিয়ম করে পত্রিকা নিয়ে রাস্তায় বের হন।
সাপ্তাহিক দুনিয়ার কর্ণধার ও রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, একদিন বোনের স্বামী আবদুল আজিজের সঙ্গে সাপ্তাহিক দুনিয়া অফিসে এসেছিলেন খুকি। আবদুল আজিজ খুকির জন্য চাকরি চাইছিলেন। লিখতে না জানায় তার চাকরি হয়নি। শেষে রসিকতা করে বলেছিলাম, ‘তার জন্য হকার হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছি না।’
কয়েক দিন পরই খুকি ‘দুনিয়া’ অফিসে হাজির। বাঁচার জন্য চাকরিটা তার দরকার। তিনি ২০ কপি দিয়ে শুরু করে সপ্তাহে ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করতেন। তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক দেয়া হয়। ধীরে ধীরে তিনি শহরের অন্যান্য স্থানীয় দৈনিকও বিক্রি শুরু করেন।
সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, খুকির আচরণ বুদ্ধিদীপ্ত, কথা বলেন সুন্দর করে গুছিয়ে, নিয়মানুবর্তিতার কারণে গ্রাহকরা তার কাছ থেকে কাগজ কিনতে পছন্দ করেন। তবে কম বয়সে রাস্তায় হয়রানি আর লাঞ্ছনাও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবু দমেননি। জীবন সায়াহ্নে এসে খুকির পেপার বিক্রির কাজ কষ্টকর বলে জানান রাজশাহীর সিনিয়র এই সাংবাদিক। তিনি খুকির জন্য একটা দোকানের ব্যবস্থা করে সেখানে বই, সংবাদপত্রের সঙ্গে অন্য কিছু বিক্রির সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।
রাজশাহী শহরের সংবাদপত্র হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা জামিউল করিম সুজন জানান, খুকি এখনো প্রতিদিন তিন শতাধিক কপি পত্রিকা বিক্রি করেন। আগে আরও বেশি বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন সংবাদপত্রের বিক্রি কিছুটা কমেছে।
সুজন বলেন, তিনি (খুকি) নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কেনেন, কখনো বাকি রাখেন না। কারো কাছ থেকে সহায়তা নেন না, নেয়াটা অসম্মান বলে মনে করেন। বরং যাদের প্রয়োজন তাদের তিনি দান করেন।
এদিকে, সম্প্রতি খুকিকে নিয়ে প্রচারিত পুরোনো একটি খবরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই খবরের সূত্র ধরে অনেকেই তার নগরীর শিরোইল এলাকার বাড়িতে যাচ্ছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এরই মধ্যে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল খুকির বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে খাদ্য ও অর্থসহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তার জীর্নশীর্ণ বাড়িটি সংস্কারে আশ্বাসও দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
এর আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম খুকির বাড়িতে নলকূপ বসিয়ে পানির সংকট দূর করেন। এতো দিন জঞ্জালে ভরপুর খুকির বাড়িটি পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে খুকির বাসায় নতুন টেলিভিশন-ফ্যান দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশীর মাধ্যমে খুকির তিন বেলা খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
খুকির তেমন চাওয়া নেই। তার ইচ্ছা কেবল মৃত্যুর পর তাকে যেন কুষ্টিয়ায় দাফন করা হয়। তার সম্পত্তি কুষ্টিয়া জেলা শহরের একটি স্কুল ও হাসপাতালে দান করা হয়। কিন্তু কীভাবে শেষ এই ইচ্ছাপূরণ করবেন তা জানেন না খুকি।তবে খুকি এখন যেনো একা নন, অগুণতি মানুষ তাঁর জীবন সংগ্রামে যেমন মুগ্ধ, তেমনি এগিয়ে আসছেন তাঁর সহযোগিতায়।